সারাদেশ

দ্রুত ন্যায় নিশ্চিত করণে রাষ্ট্রের কর্তব্য: বরগুনার সন্তান সোহাগ হত্যার ঘটনায় দ্রুত বিচারের প্রয়োজনীয়তা ও ন্যায়পরায়নতা

দ্রুত ন্যায় নিশ্চিত করণে রাষ্ট্রের কর্তব্য: বরগুনার সন্তান সোহাগ হত্যার ঘটনায় দ্রুত বিচারের প্রয়োজনীয়তা ও ন্যায়পরায়নতা

প্রকাশিত : ১৩ জুলাই ২০২৫, দুপুর ১২:২৪ আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৫, দুপুর ১২:৩১

সম্প্রতি একজন ব্যবসায়ী (সোহাগ) দুষ্কৃতকারী দ্বারা জনসমক্ষে হত্যাকান্ডের শিকার হয়। যার মাধ্যমে সমাজে একটি সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া না থাকা এবং উক্ত অপরাধের উপর জনতার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। এমন একটি নৃশংস ঘটনার ওপর দ্রুত বিচারের দাবি অনস্বীকার্য; কারণ এটি শুধু নিহতের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে না, বরং রাষ্ট্রের আইনী ক্ষমতা ও সামাজিক শান্তির ভিত্তিকে রক্ষা করার আগামীর ভিত্তি নির্ধারণ করে। প্রকাশ্যে সংঘটিত অপরাধ, সাধারণ বিচারিক প্রক্রিয়ায় দ্রুত নিষ্পত্তি পায় না। পুলিশ প্রতিবেদন, সাক্ষ্য জালিয়াতি, রাজনৈতিক প্রভাব—এসব মিলিয়ে বিচারিক দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায়। ফলে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিলম্বিত হয়, যা সমাজে সহিংসতার সংস্কৃতি তৈরি করে।

সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং ৩৫ অনুচ্ছেদে ন্যায্য বিচারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র বনাম দেলোয়ার হোসেন, (৩৮ ডি.এল.আর. ২৪৬) ও শুক্কুর আলী বনাম রাষ্ট্র, (৬০ ডি.এল.আর. এডি ৯০) মামলায় উচ্চ আদালত দ্রুত ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক নীতি অনুসারে বিচার হতে হবে দ্রুত, নিরপেক্ষ এবং জনসম্মুখে দৃশ্যমান। যখন হত্যাকাণ্ড ভিডিও ফুটেজে প্রমাণিত হয়, তখন দীর্ঘ বিচারিক বিলম্ব এই প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশ ICCPR-এর ১৪ অনুচ্ছেদে স্বাক্ষরকারী হওয়ায়, বিচার বিলম্ব না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। UN-এর বিচারিক স্বাধীনতা বিষয়ক মূলনীতিতেও দ্রুত বিচারকে অপরিহার্য বলা হয়েছে। ভারতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট এবং ইতালির অ্যান্টি-মাফিয়া ট্রাইব্যুনাল বিশেষ পরিস্থিতিতে কার্যকর হয়েছে।

এ ধরনের অপরাধের মাধ্যমে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আইনের প্রতি অনাস্থা গড়ে ওঠে। অপরাধতত্ত্ব অনুযায়ী, এগুলো \\\'মোরাল প্যানিক\\\' সৃষ্টি করে এবং অপরাধীরা তা ব্যবহার করে সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

রিফাত শরীফ, নুসরাত জাহান এবং সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড জনসাধারণের ক্ষোভ ছিল প্রবল। তবে বিচার বিলম্বিত হওয়ায় সমাজের আস্থা দুর্বল হয়েছে। বিচার না হলে ভবিষ্যতে আমাদের সমাজে  অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।

দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া বিচার প্রক্রিয়ার ফলে আহত পরিবারের সাধারণ জীবন এবং সামাজিক ও বিচারিক ন্যায়বোধ খর্ব হচ্ছে। দ্রুত বিচারপ্রাপ্তি, তীব্র শোকে থাকা পরিবারকে মানসিক শান্তি দেয় এবং রাষ্ট্রকে শক্তিশালী ন্যায় পরায়ণতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সর্বস্তরের জনগণ দ্রুত শাস্তির দাবি করে; দ্রুত বিচার তার সাথে যেন এক সময়ের দাবিতে পরিণত হওয়া অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। তবে তাতে ন্যায়ের স্ববিরোধতা না ঘটে এমন প্রক্রিয়া দরকার।

সোহাগ হত্যার ঘটনার মতো প্রকাশ্য ভিডিও, স্থিরচিত্র এবং সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসা তথ্য দ্রুত বিচার কাঠামোর বড় সহায়ক, কেননা তা ঘটনাকে সময় সাপেক্ষ এবং অপ্রকাশ্যতা থেকে উদ্ধার করে।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ- ৩৫(৩) অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য “স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচার” প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, যা প্রত্যেক নিহত ও তার পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রাপ্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মন্থর বিচার প্রক্রিয়া ও বিচারহীনতার প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে তার বাস্তব রূপ সামাজিক আচরণের মধ্যে কোনভাবেই লক্ষণীয় নয়।

ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা, ৩৬৩(ক-খ) ও বর্তমান দ্রুত বিচার ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে বলা যায় এসব ধারায় দ্রুত বিচার, কোর্ট গঠন ও সময়সীমা নির্দিষ্ট করার বিধান রয়েছে; যা প্রয়োগে রাষ্ট্র কার্যকরী আইনানুগ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সাক্ষ্য আইনের ধারা, (৪৪-৪৫) ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী- লাইভ ভিডিও, সিসিটিভি ও মোবাইল রেকর্ডিং স্বচ্ছভাবে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য;যদি প্রমাণ নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে আসে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা, ৩৬৩(ক-খ) এর আওতায় ‘স্পট কিলিং ট্রাইব্যুনাল’ গঠন যা ৬ মাসের মধ্যে রায় প্রদান করবে।

ডিজিটাল প্রমাণের বিচারিক প্রক্রিয়ায়, প্রমাণের নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতকরণের জন্য সাক্ষ্য আইনে সংশোধন করে প্রমাণের যাচাই-প্রক্রিয়া ডিজিটাল তথ্যের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে।

স্বচ্ছ শুনানি ও দ্রুত আপিল ব্যবস্থা বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করনের মাধ্যমে উক্ত আপিল সর্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান, মধ্যবর্তী ‘habeas corpus’র ব্যবস্থা নিশ্চিত করে দ্রুততার সাথে স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা ন্যায় বিচারের স্বার্থে নিশ্চিত করতে হবে।

UNODC বা UPR স্টাইলের বিশুদ্ধ পর্যবেক্ষণ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করবে।

স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে পর্যবেক্ষণ ও তথ্যের প্রকাশযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

বিচারক ও আইনজীবীদের সামাজিক বাস্তবতা, ডিজিটাল,ফরেনসিক্ ও শোকগ্রস্ত পরিবারের মানসিক অবস্থার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দক্ষ বিচার ব্যবস্থা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

চলমান বিচারের সময়, মৃতের পরিবার ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সচেতন এবং সম্মানজনকভাবে প্রশাসনিক পর্যায়ে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।

সোহাগ হত্যাকাণ্ডের সাম্প্রতিক এই ঘটনায় জনমানুষ এবং রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কেবল “শাস্তি” নয়, বরং প্রমাণ, ন্যায় এবং সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির ওপর নির্ভর করে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত না হলে, নিহতের ন্যায়বোধ দূর্বল হবে এবং রাষ্ট্রের আইনী কাঠামো প্রশ্নবিদ্ধ হবে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হলো আলোচিত ঘটনার মতো বিশেষ ক্ষেত্রে দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা চালু করা, নাহলে আইনের উপর মানুষের সহযাত বিশ্বাস সমাজে বসবাস করা মানুষের মধ্যে থেকে দিনে দিনে নিঃশেষ হবে ও বিচার ব্যবস্থা এবং বিচারে অবিশ্বাসী এক সমাজে পরিণত হবে।

লেখকঃ

মাহিন মেহেরাব অনিক 

আইনজীবি, 

বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট(হাইকোর্ট বিভাগ)

সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটর,

বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, ১ম আদালত, বরগুনা