ঢাকা

মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি, আইনিদৃষ্টিকোণ, এবং ভবিষ্যতের করণীয়

মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি, আইনিদৃষ্টিকোণ, এবং ভবিষ্যতের করণীয়

প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০২৫, সকাল ১০:০৩

২১ জুলাই ২০২৫,সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিট।ঢাকার উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা যখন শিক্ষারত, ঠিক তখনই একটি বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা।বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি ‘F-7 BGI\\\\\\\'  যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে স্কুল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়।মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন, মৃত্যু, কান্না এবং বিভীষিকা।

এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২৭ জনের প্রাণহানি, শতাধিক আহত এবং পুরো জাতি এক গভীর শোকে মুহ্যমান।নিহতদের অধিকাংশই শিশু ও তরুণ শিক্ষার্থী—যাদের স্বপ্ন,পদচারণা আর ভবিষ্যতের জয়োরথি হওয়ার অপার সম্ভাবনা ফিরে আসবে না কখনোই। 

এই হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্য সমগ্র জাতি গভীরভাবে শোকাহত।নিহতদের পরিবার ও আহতদের প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে গভীর সমবেদনা রইল।একটি জাতি যখন তার শিক্ষার্থীদের প্রাণ এভাবে হারায়, তখন তা শুধুই একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবিও প্রতিফলিত হয়।আমি এই ট্র্যাজেডিকে কেবল শোকের চোখে নয়, পরিবর্তনের আহ্বান হিসেবেও দেখি।এটি প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রের অবহেলার একটি ক্লাসিক উদাহরণ।একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান কেন এত জনবহুল আবাসিক এলাকায় ওড়ানো হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও নিরাপত্তা নীতিমালার দুর্বলতা স্পষ্টতই প্রতীয়মান।

সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা সংরক্ষিত। এ ধরনের দুর্ঘটনা নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের সামিল।

ফৌজদারি দৃষ্টিকোণ থেকে দণ্ডবিধির ৩০৪-ক ধারা (অবহেলাজনিত মৃত্যু) অনুযায়ী তদন্ত হওয়া এবং সেই অনুযায়ী দৃশ্যমান বিচার নিশ্চিত হওয়া ভবিষ্যতের মানবিক জীবন নিরাপত্তার জন্য অনস্বীকার্য।এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

বিমানটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থায় ত্রুটি স্পষ্টত দৃশ্যমান।বিকল্প ইঞ্জিন বিকল হলে জরুরি অবতরণের ব্যবস্থা ছিল না। বোঝা যায়, যান্ত্রিক ত্রুটি শনাক্ত করার আধুনিক ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রীয় বিমানশিল্পে আজও অনুপস্থিত।জনমনে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, রাজধানীর জনবহুল অঞ্চলে যুদ্ধবিমান ওড়ানোর অনুমতি কিভাবে দেওয়া হলো?

যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হলে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কোনও পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না কেন? শিশুদের মানসিক আঘাত, অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা এবং শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ।সন্তান ও সজন হারানো পরিবারগুলোর জীবন ভেঙে পড়েছে।জাতির মননে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হল সেই ২৪ এর জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও মানুষের মৃত্যুর ভয়াবহতার দিনগুলোর মতই। 

এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া এখন সময়ের দাবি এবং অত্যাবশ্যক-

1. বিমান প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত আকাশসীমা পুনর্নির্ধারণ করা হোক, যাতে তা জনবসতিপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে চলে।

2. প্রতিটি যুদ্ধবিমানে লাইভ ট্র্যাকিং, ইঞ্জিন অ্যালার্ট ও জিপিএস ভিত্তিক জরুরি অবতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।

3. বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও উড্ডয়ন পূর্ব নিরাপত্তা চেকিং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আধুনিকায়ন করা হোক।

4. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সেফটি ও ইমারজেন্সি রেসপন্স প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হোক।

5. বিমান বাহিনীর ভুল বা অবহেলার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের দ্রুত ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করা হোক।

6. রাষ্ট্রীয় বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে রিপোর্ট প্রকাশ ও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক।

একটি জাতি তখনই সভ্য ও দায়িত্বশীল, যখন সে ব্যর্থতার পরও শিখতে জানে, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষনীয় আকারে পূর্ব প্রস্তুতি নিতে জানে।মাইলস্টোনের এই দুর্ঘটনা যেন শুধু স্মরণ নয়, এক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক জাগরণের সূত্রপাত হয়।একটিও শিশুর মৃত্যু যেন ভবিষ্যতে অবহেলায় না ঘটে—এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।

মাহিন মেহেরাব অনিক

আইনজীবি,

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ)

সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর,

বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, আদালত-১, বরগুনা।