বাংলাদেশের কম বেশি প্রায় সব জনপদেই এখনো চোখে পড়ে নানা রকমের মাটির ঘর। মাটির দেয়াল ঘেরা এসব ঘর বুকে ধারণ করে আছে বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর।
সুপ্রিয় দর্শক, মাটির ঘরের সন্ধানে খুঁজতে খুঁজতে আজ আমরা চলে এসেছি সিরাজগঞ্জের তাড়াশে। এই এলাকার নানা জায়গায় এখনো দেখা মেলে মাটির ঘরের, যা ধরে রেখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ঐতিহ্য। গরমকালে শীতল আর শীতকালে উষ্ণ থাকার জন্য অনেকেই একে ভালোবেসে বলেন গরিবের এসি ঘর। আপনি কি জানেন, মাটির ঘরগুলোই এক সময় ছিল গ্রামীণ জীবনের প্রাণ? এগুলো শুধু থাকার জায়গা নয়—এগুলো আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস আর প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের প্রতীক। আজ আমরা জানবো মাটির ঘরের গল্প—এর অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। আপনাদের সঙ্গে আছি আমি আদ্রিতা সরকার।
একসময় বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলে মাটির ঘরের প্রচলন ছিল গ্রামীণ জীবনের প্রাণের মতো। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এগুলো শুধু আশ্রয়ের স্থান নয়, বরং আমাদের ঐতিহ্য ও শিকড়ের প্রতীক হিসেবে টিকে এসেছে। কাঠ, বাঁশ, আঠালো এটেল মাটি আর খড়ের মিশ্রণে তৈরি এই ঘরগুলো গ্রীষ্মে শীতল আর শীতে উষ্ণ থাকে—প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়ার এক চমৎকার নিদর্শন। প্রতিটি দেয়ালের গায়ে লুকিয়ে আছে গ্রামীণ জীবনের অগণিত গল্প—হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ আর মাটির গন্ধে ভেজা স্মৃতির সঞ্চয়।
শুধু মাটি আর খড় দিয়ে তৈরি হলেও, এই ঘরগুলোতে লুকিয়ে আছে শিল্পীর ছোঁয়া। দেওয়ালের মসৃণ পৃষ্ঠে ফুটে ওঠে ফুল, পাখি আর জ্যামিতিক নকশা—সবই হাতের কারুকাজ। এসব নকশা শুধু সৌন্দর্য বাড়ায় না, গ্রামের মানুষের নান্দনিকতা আর সৃজনশীলতার গল্পও বলে। প্রতিটি অলংকরণ যেন বলে দেয় এ ঘর কেবল থাকার জায়গা নয়, এটি এক জীবন্ত শিল্পকর্ম।
গ্রামীণ নারীদের স্নেহমাখা হাতের ছোঁয়ায় মাটির ঘরের দেওয়ালে ফুটে ওঠে নানান জ্যামিতিক নকশা । এগুলো সবই তৈরি হয় মাটি, খড়, আর প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে। গ্রামীণ নারীরা প্রায়ই এই নকশাগুলো তৈরি করেন, ঋতুভেদে বা বিশেষ উৎসবে এই কারুকাজ বদলে যায় । এসব নকশা শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়—এগুলো প্রমাণ করে গ্রামের মানুষের নান্দনিক বোধ, ধৈর্য, আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা
মাটির ঘর বানাতে কাঠামোর ভিত গড়ে তোলা হয় বাঁশ ও কাঠ দিয়ে। তারপর মাটি, খড় আর পানি মিশিয়ে কাদা বানিয়ে হাতেই গড়ে তোলা হয় দেওয়াল। গ্রীষ্মে দেয়াল শীতল রাখে, শীতে দেয় উষ্ণতা—এক প্রকার প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশন।
প্রথমে বাঁশের কাঠামো শক্ত করে বাঁধা হয়। এরপর এটেল মাটি, খড়, আর পানি মিশিয়ে বানানো হয় শক্ত কাদা, যা হাত দিয়ে স্তর ধরে দেয়ালে বসানো হয়। প্রতিটি স্তর শুকিয়ে গেলে তার ওপর দেওয়া হয় নতুন কাদার প্রলেপ, যা দেয়ালকে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করে। সঙ্গে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
মাটির ঘরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি পরিবেশবান্ধব এবং খুব কম খরচে তৈরি করা যায়। তবে বৃষ্টির পানি আর আধুনিকতার ঢেউয়ে এই ঘরগুলো দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণও এখানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেয়ালে ফাটল ধরলেই গ্রামীণ কারিগরেরা তা দ্রুত লেপে মেরামত করে নেন, যেন ঘরটি আবার আগের মতো টিকে থাকে।
মাটির ঘরের ভেতর গ্রীষ্মে থাকে ঠান্ডা, শীতে থাকে উষ্ণ। নির্মাণ খরচও তুলনামূলকভাবে খুব কম। তবে অসুবিধাও আছে—বর্ষায় বৃষ্টির পানিতে দেয়ালে ফাটল ধরতে পারে, আর তা দ্রুত মেরামত না করলে ঘরের আয়ু কমে যায়। শহরমুখী মানুষের জীবনযাত্রা ও আধুনিক স্থাপত্যের প্রভাবেও মাটির ঘরের জনপ্রিয়তা দ্রুত হারাচ্ছে। আগে যেখানে প্রায় প্রতিটি গ্রামে সারি সারি মাটির ঘর দেখা যেত, এখন সেখানে গজিয়ে উঠছে কংক্রিটের ভবন আর টিনের ঘর।
সময়ের সাথে সাথে গ্রামীণ জীবনে এসেছে বড় পরিবর্তন। কংক্রিটের দেয়াল আর টিনের ছাউনিতে ঢেকে যাচ্ছে আমাদের শিকড়ের গল্প। একসময়ের জীবনের অংশ, সেই মাটির ঘরগুলো আজ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির অ্যালবামে। যতদিন না আমরা এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছি, ততদিন এই ঐতিহ্য হয়তো একদিন বইয়ের পাতায় আর পুরনো ছবিতেই আটকে যাবে।
একসময়ের সাধারণ দৃশ্য—মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনি, উঠোনে শীতল ছায়া—আজ খুব কমই দেখা যায়। নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে ইট-কাঠের বাড়িতে, ফলে তারা মাটির ঘরের অনুভূতি আর প্রয়োজনীয়তা বুঝে ওঠার সুযোগই পাচ্ছে না। যেসব ঘর এখনো টিকে আছে, সেগুলোও প্রতিনিয়ত সময় আর প্রকৃতির আঘাত সামলাতে সামলাতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। যদি এখনই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তবে খুব শিগগিরই এ ঘরগুলো কেবল বইয়ের পাতা আর পুরনো ছবিতে বেঁচে থাকবে।
প্রেজেন্টার অন-ক্যামেরা: আবহমানকাল ধরে মাটির ঘর আমাদের সংস্কৃতিকে লালন করে এসেছে। এর প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে আমাদের জীবনের গল্প, হাসি-কান্নার স্মৃতি আর শিকড়ের মমতা।
হয়তো একদিন এসব ঘর কেবল ছবি বা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হবে, কিন্তু যতদিন তারা দাঁড়িয়ে আছে, ততদিন তারা আমাদের শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেবে আমরা কোথা থেকে এসেছি, আর কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বেঁচে ছিলাম।
মাটির ঘরের এই গল্প নিয়ে আজকের পর্ব শেষ করছি, এতক্ষণ আপনাদের সঙ্গে ছিলাম আমি, আদ্রিতা সরকার।
মতামত